দিনপঞ্জিকার পাতা উল্টে একটু পেছনে যাই। ৪ আগস্ট, সকাল নয়টা। আকাশ ফকফকা। রোদের ছটা এসে পড়ছিল পিচঢালা সড়কের গায়ে। নিউমার্কেট মোড় তখনো ফাঁকা। চারদিকে দোকানপাট বন্ধ। যানবাহন চলছে না। থমথমে পরিবেশ।
১০ মিনিট গত হওয়ার পর হইহই শব্দ। কিছুটা নিঃশব্দে কোতোয়ালি মোড়ের দিকে এগিয়ে যাই। দেখলাম একদল শিক্ষার্থী মিছিল নিয়ে মোড়ের দিকে ধাবমান। তাদের মাথায় শক্ত করে বাঁধা জাতীয় পতাকা। মুখে স্লোগান—‘আমার ভাই মরল কেন/ জবাব চাই, জবাব চাই’, ‘বুকের ভেতর অনেক ঝড়/ বুক পেতেছি গুলি কর’, ‘আমার খায়, আমার পরে,/ আমার বুকেই গুলি করে’।
এক, দুই, তিন করে গুনে দেখলাম ১৬ জনের একটা দল নিউমার্কেট মোড়ে এসে দাঁড়াল। একজনের বুকে লেখা ‘এক দুই তিন চার/ স্বৈরাচার দেশ ছাড়’। এই তরুণেরা ছিলেন দুর্বার, অদম্য। ভয়কে ছারখার করে তাঁরা সেদিন দখল করেছিলেন ঐতিহাসিক নিউমার্কেট মোড়। এরপরের দুই ঘণ্টায় মোড়ে আর ঠাঁই নেই দশা। চারদিক থেকে খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে মোড়ে এসে জমা হচ্ছিলেন ছাত্র-জনতা। কেউ একা, কেউ সদলবলে—প্ল্যাকার্ড হাতে এসেছিলেন তাঁরা।
আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগের দাবিতে সেদিন নিউমার্কেট মোড় কার্যত জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছিল। সদরঘাট, স্টেশন রোড, আমতল—এই তিন সড়ক নদীর মতো এসে মিশেছিল মোড়ে। ছাত্রছাত্রীরা ভয়কে দূরে ঠেলে দিয়ে নেমে পড়েছিলেন রাস্তায়। আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগের দাবি উঠেছিল মূলত কোটা সংস্কারকে কেন্দ্র করে। কোটা সংস্কার আন্দোলন লাগাতারভাবে শুরু হয় গত ১ জুলাই। অন্তিম পরিণতি ঘটে ৫ আগস্ট। দেশ–কাঁপানো আন্দোলনে পতন হয় শেখ হাসিনা সরকারের।
‘বিদ্রোহী রণক্লান্ত’
৪ আগস্টের সেই সকালটা ছিল অনিশ্চয়তায় মোড়ানো। বেলা ১১টা পর্যন্ত আন্দোলনকারীরা স্লোগান আর বিপ্লবী গানে মাতোয়ারা ছিলেন। সমস্বরে কেউ গাইছিলেন ‘মুক্তিরও মন্দিরে’। আবার একদল পাঠ করছিল কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা। কণ্ঠে কণ্ঠে ছড়িয়ে পড়ছিল—‘যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না/ অত্যাচারীর খড়্গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না/ বিদ্রোহী রণক্লান্ত/ আমি সেই দিন হব শান্ত’।
বেলা ১১টার পরপর বিকট শব্দে কেঁপে ওঠে দুই কান। অমর চাঁদ সড়ক থেকে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতা-কর্মীরা মোড়ের দিকে গুলি ছুড়তে শুরু করেন। ককটেলের বিস্ফোরণও হয়। তবে ছাত্র-জনতা পিছপা হননি। তাঁরাও প্রতিরোধের চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিলেন। মুহূর্তে দুই পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া, সংঘর্ষে রণক্ষেত্র হয়ে যায় নিউমার্কেট মোড়। একপর্যায়ে পুলিশও ছাত্র-জনতাকে লক্ষ্য করে কাঁদানে গ্যাসের শেল, সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়তে থাকে। পুরো এলাকা ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। দিগ্বিদিক ছুটতে থাকেন দিশাহারা ছাত্ররা।
ছাত্র-জনতার একটি অংশ নিউমার্কেটের পাশে রেয়াজউদ্দিন বাজার, তামাকুমুণ্ডি লেনের বিভিন্ন বিপণিবিতানের ভেতরে ঢুকে পড়ে। একটি অংশ স্টেশন সড়ক হয়ে কদমতলী, আরেকটি অংশ লালদীঘি হয়ে আন্দরকিল্লা, আর কেউ কেউ চলে যান এনায়েত বাজারের দিকে। সংবাদকর্মীরা ঝুঁকি সত্ত্বেও মোড়ের আশপাশে ঘটনার পর্যবেক্ষণে ছিলেন। আমরা দেখলাম, অমর চাঁদ সড়ক থেকে একটা রিকশা আমতলের দিকে এগোচ্ছে। রিকশায় শোয়া আহত এক যুবক। চালক সর্বশক্তি দিয়ে প্যাডেল ঘোরাচ্ছেন। সেদিন ১৮০ জনের মতো আন্দোলনকারী আহত হয়েছিলেন। বেশির ভাগই ছিলেন গুলিবিদ্ধ। তাঁদের নিয়ে যাওয়া হয় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজসহ নগরের বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে।