নেতাকর্মীর হতাশা, ক্ষোভ প্রশমিত করে আবারও রাজপথের আন্দোলনে ফিরতে চায় বিএনপিসহ সমমনা রাজনৈতিক দল ও জোট। এ জন্য দফায় দফায় বৈঠক করছেন জোট নেতারা। এতে বিগত আন্দোলন নিয়ে মূল্যায়নের পাশাপাশি নতুন কর্মসূচির রোডম্যাপ নিয়ে বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। পরবর্তী আন্দোলন মধ্যবর্তী নির্বাচনের জন্য, নাকি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে করা হবে, সে বিষয়েও বিস্তারিত আলোচনা করছে দল ও জোটগুলো। তবে এখনও কিছু চূড়ান্ত হয়নি।
বিএনপি নেতারা জানান, দলের হাইকমান্ড আবারও রাজপথের আন্দোলনে ফিরতে চান। এ জন্য আবার আটঘাট বেঁধে মাঠে নামার প্রস্তুতিও শুরু করেছেন। সেজন্য একদিকে কৌশলগত কারণে ভারতবিরোধী ‘কঠোর অবস্থান’ থেকে সরে এসে মধ্যপন্থা অবলম্বনের ইঙ্গিত রয়েছে। আবার অন্য দেশগুলোর সঙ্গেও কৌশলগত সম্পর্ক বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যু নিয়ে আন্দোলন শুরু করার পরিকল্পনা থাকলেও একে ধীরে ধীরে রাজনৈতিক রূপ দেওয়ার সিদ্ধান্ত রয়েছে বলে বিএনপির বেশ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতা জানান।
তারা বলেন, দেশের ভঙ্গুর অর্থনৈতিক অবস্থা, দ্রব্যমূল্যের সীমাহীন ঊর্ধ্বগতি আর ক্ষমতাসীন দলের প্রতি জনঅনাস্থায় আগামীতে গণবিস্ফোরণ ঘটবে বলে তারা মনে করছেন। তাই বিএনপি রাজনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবে এসব ইস্যুতে জনগণকে আরও সচেতন করতে বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামার পরিকল্পনা করছে। এসব কর্মসূচি জোরালো করতে সমমনা দলগুলোকেও পাশে টানতে চান তারা। এর অংশ হিসেবে বিএনপি নেতারা মিত্র দলগুলোর সঙ্গে মতবিনিময় এবং কর্মকৌশল নিয়ে আলোচনা করছেন।
জানা গেছে, বিএনপির সঙ্গে বৈঠকের পর নিজেদের মধ্যে আলোচনা শুরু করেছে ওইসব দল ও জোট। সেখানে তারা আন্দোলনের কর্মপদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবেন। পরে বিএনপির লিয়াজোঁ কমিটির সঙ্গে বৈঠকে সেসব কর্মপরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করবেন জোট নেতারা। তার ভিত্তিতে বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সভায় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানা গেছে।
বিএনপি গত ১২ মে থেকে যুগপৎ আন্দোলনের শরিক দল ও জোটগুলোর সঙ্গে বৈঠক শুরু করে এবং গত বৃহস্পতিবার তা শেষ হয়। আনুষ্ঠানিক ওই বৈঠকের পাশাপাশি অনানুষ্ঠানিক আলোচনাও চলে এ সময়। বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের সঙ্গেও আলাপ-আলোচনা চালায়। এ ছাড়া যুগপৎ আন্দোলনের বাইরে থাকা বেশ কয়েকটি ডান-বাম আর ইসলামী দলের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে বিএনপি।
বিভিন্ন বৈঠকে উপস্থিত বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পরবর্তী আন্দোলনের কর্মপরিকল্পনা, স্থানীয়সহ অন্য নির্বাচন নিয়ে বিএনপির অবস্থান এবং সমমনা দল ও জোট নিয়ে তাদের মনোভাবের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। সেখানে আন্তর্জাতিক প্রভাবক হিসেবে ভারতের প্রসঙ্গও এসেছে।
জোটের কয়েকজন নেতা জানান, জাতীয় নির্বাচনের পর ভারতের বিরুদ্ধে বিএনপির যে মনোভাব সৃষ্টি হয়েছিল, কৌশলগত কারণে সেখান থেকে বিএনপি অনেকটা পিছুটান দিয়েছে বলে তারা মনে করছেন। ভারতবিরোধী কর্মসূচি পালনে জোট নেতাদের ধীরে চলার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে বলেও তারা জানান।
কয়েকজন নেতা বলেন, ১২ দলীয় জোট ছাড়াও কয়েকটি দলের সঙ্গে পৃথক বৈঠকে জামায়াতের প্রসঙ্গও এসেছে। এর মধ্যে কোন কোন দল এবং জোট জামায়াতকে যুগপৎ আন্দোলনে নেওয়ার জন্য বিএনপিকে পরামর্শ দিয়েছে।
বৈঠকের ব্যাপারে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেছেন, আন্দোলনের জন্য কী ধরনের কর্মসূচি গ্রহণ করা যায় এবং কীভাবে লক্ষ্যে পৌঁছানো যায়, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে প্রাথমিক আলোচনা করছেন। মূল কথা নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে অবাধ নির্বাচন। সে লক্ষ্যে তারা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলন ইস্যুতে আলোচনা করেছেন।
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না সমকালকে বলেন, আন্দোলনের মূল্যায়ন এবং ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ৭ জানুয়ারির আগের এবং পরের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। পাশাপাশি ভবিষ্যৎ কর্মসূচি এবং পরিকল্পনা নিয়ে বিস্তারিত কথা হয়েছে বৈঠকে।
ভারত নিয়ে নতুন চিন্তা
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পক্ষে ভারতের দৃশ্যমান পক্ষপাতিত্ব ছিল বলে অভিযোগ বিএনপির। যদিও ভারত তা অস্বীকার করেছে। দিল্লির সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে দীর্ঘদিন কাজ করেও কোনো সুফল না পাওয়ায় ভারতবিরোধিতাকে ফের সামনে আনেন দলের নেতারা। তারা বলেছেন, বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের বিপক্ষে ভারত। জনগণকেও ভারতবিরোধী অবস্থানে উদ্বুদ্ধ করার কৌশল নিয়েছিল দলটি। ভারতবিরোধী মনোভাব তীব্র করে জনগণের মধ্যে নিজেদের অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করার কৌশলও নিয়েছিল ১৭ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটি। এ জন্য সমমনা দল ও জোটকেও কাজে লাগানো হয়।
দলের তৃণমূল নেতাকর্মী ছাড়াও বিভিন্ন জোট ও দলের নেতাকর্মী ভারতবিরোধী কর্মসূচি পালন করেন। ভারতীয় পণ্য বর্জনেরও ডাক দেয় বেশ কয়েকটি সংগঠন। এ ইস্যুতে অবশ্য বিএনপির হাইকমান্ডের মধ্যে বিভক্তি ছিল।
সংসদ নির্বাচনের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভারতবিরোধী প্রচারণা শুরু হলে দলটির নেতাকর্মীরা তাতে শামিল হন। গত ২০ মার্চ দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী নয়াপল্টনের দলীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে সেই আন্দোলনের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেন। তিনি তাঁর গায়ে থাকা ভারতীয় চাদর ছুড়ে ফেলে দেন। তাঁর সঙ্গে থাকা কর্মীরা সেই চাদর সেখানে আগুন দিয়ে পোড়ান। পরে রিজভী বলেন, ‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইনের প্রতি সংহতি প্রকাশ করে তিনি তাঁর ব্যবহার করা ভারতীয় চাদর ফেলে দিয়েছেন। এরপর থেকেই ভারতবিরোধী প্রচারণায় বিএনপির সম্পৃক্ততার বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে।
রিজভীর ওই প্রতিবাদের পর মহান স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে বিএনপির মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশের ব্যানারেও ভারতীয় পণ্য বর্জন করার আহ্বান ছিল। এ অবস্থায় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হলেও কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি দলটি।। আগামীতে এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা-বিশ্লেষণের পর দলের অবস্থান ঠিক করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পরে দলের নীতিনির্ধারকরা ভারতবিরোধী কট্টর অবস্থান থেকে সরে কৌশলে হাঁটার পরিকল্পনা নিয়েছেন। তবে প্রতিবেশী দেশটি আবারও বাংলাদেশে গণতন্ত্রের বিপক্ষে অবস্থান না নিলে ভিন্ন চিন্তাও রয়েছে দলের হাইকমান্ডের।