১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এরপর ৬ ফেব্রুয়ারি ভারত সরকারের আমন্ত্রণে তিনি ভারতে যান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ১৯৪৯ সালে বঙ্গবন্ধুকে দেওয়া বহিষ্কারের আদেশ প্রত্যাহার করে। আর ২৮ ফেব্রুয়ারি তিনি সোভিয়েত ইউনিয়ন সফরে যান। কাজেই এই সময়টা আজও ইতিহাসের পাতায় সমুজ্জ্বল। ১২ মার্চ ভারতীয় মিত্রবাহিনী বাংলাদেশ ত্যাগ করে। সেদিন ঢাকা স্টেডিয়ামে বঙ্গবন্ধু ভারতীয় সেনাদের বর্ণাঢ্য বিদায়ি কুচকাওয়াজে সালাম গ্রহণ করেন। ইন্দিরা গান্ধী স্বাধীন বাংলাদেশ সফর করেন ১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ। ২০২৩ সালে আবার সেই রকমই একটা ১৭ মার্চ ফিরে এসেছে। ১৭ মার্চ বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জন্মদিন। তার ঠিক পরের দিন বাংলাদেশ ও ভারতের মৈত্রীর পাইপলাইনের উদ্বোধন হলো। এই উদ্বোধন করলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এই যৌথ অঙ্গীকার সৃষ্টি করল এক নতুন যাত্রাপথ, ইতিহাসের আরেকটি মাইলফলক।
আসলে ১৯৭২ সালের ১২ মার্চ ভারতীয় সেনার প্রত্যাহার, সে ছিল বাংলাদেশকে ইন্দিরা গান্ধীর একটি উপহার। তার কারণ বঙ্গবন্ধু স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার শপথ নিয়েছিলেন। আবার এত বছর পর আরেকটা ১৭ মার্চকে স্মরণ রেখে মৈত্রী পাইপলাইনের উদ্বোধন, সেটিও এই সার্বভৌম বাংলাদেশের সাফল্য স্বীকার করে আরো এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার। ২০১৮ সালে নরেন্দ্র মোদি ও শেখ হাসিনা যে পাইপলাইনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন, ২০২৩ সালে সেটি চালু হচ্ছে। রাজনীতিতে যেমন অনেক সময় অনেক ঘোষণা হয়, অনেক প্রতিশ্রুতি আমরা পাই, কিন্তু সেগুলো বাস্তবায়িত হয় না। এ ক্ষেত্রে তেমনটা হয়নি, বাস্তবায়ন করেছে ভারত। বাংলাদেশও এ ব্যাপারে সব রকমের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। ভিডিও সম্মেলনে ভারত-বাংলাদেশের মৈত্রী পাইপলাইন উদ্বোধন করার অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হরদীপ পুরি, রামেশ্বর তেলি এবং আরো অনেক মন্ত্রী ও প্রবীণ কর্মকর্তা।
১৭ মার্চ বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জন্মদিন। সেদিন নানা রাষ্ট্রীয় ব্যস্ততা ছিল। সেই কারণে তার ঠিক এক দিন পর ভিডিও প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে ভারত মৈত্রী পাইপলাইনের উদ্বোধন অনুষ্ঠানটি হলো। এই বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী পাইপলাইনের উদ্বোধন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাইপলাইনে ডিজেল আসা শুরু হয়ে গেছে। শেখ হাসিনা বলেছেন, এই বন্ধুত্বটা অটুট থাকুক, শুধু এটাই চাই। তিনি এক বিবৃতিতে খুব আন্তরিক একটি ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। আবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও বলেছেন, আমাদের সহযোগিতা আরো বিস্তৃত হবে।
আসামের নুমালিগড় থেকে বাংলার দিনাজপুরের পার্বতীপুর পর্যন্ত ডিজেল পাইপলাইনের উদ্বোধন করতে গিয়ে নরেন্দ্র মোদি আস্থা প্রকাশ করলেন যে এটি বাংলাদেশের অর্থনীতিকে গতিশীল করার ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা নেবে। দু-একটি তথ্য এই সময় আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন যে ৪৭ লাখ লিটার ডিজেল সর্বদা এই পাইপলাইনে সংরক্ষিত থাকবে। সাশ্রয় হবে সময় এবং কমবে জ্বালানি পরিবহনের খরচ। আসলে বাংলাদেশে ডিজেল আমদানি একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অর্থনীতি। মোংলা-চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর, সিলেট-চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, সৈয়দপুর বিমানবন্দর—এগুলো শেখ হাসিনা ভারতের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছেন, যাতে ভারতের এগুলো ব্যবহার করতে কোনো অসুবিধা না হয়। এর ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য আরো সহজ হবে। দুই দেশের মানুষের মধ্যে ব্যাবসায়িক লাভ বাড়বে। ১০০টা অর্থনৈতিক অঞ্চলে ভারতীয় বিনিয়োগ শেখ হাসিনা প্রত্যাশা করছেন। ভারতও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এই ডিজেল পাইপলাইন চালু হওয়া এবং এই অর্থনৈতিক সংস্কৃতি রূপায়ণের ফলে উত্তরাঞ্চলের ১৬টি জেলা সরাসরি উপকৃত হবে।
দক্ষিণ এশিয়া উপমহাদেশের পরিবর্তনশীল সমাজ, তথা সমাজ কাঠামো, সামাজিক শ্রেণি বা সামাজিক স্তরবিন্যাস—এগুলো বাংলাদেশের উন্নয়ন বোঝার জন্য বিশেষভাবে জরুরি। কেননা ১৯৭১ সালে অনেক ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ জন্ম নিয়েছে। আরম্ভের আগেও তো আরম্ভ থাকে।
প্রাক-ব্রিটিশ ভারতে ভূমি ছিল সম্পদের প্রধান ধরন। কৃষি ছিল প্রধান অর্থনীতি। বিত্তবান সমাজ ছিল কৃষি ও অর্থনীতির ওপর নির্ভরশীল। ভারতের কৃষি-অর্থনীতি গ্রামীণ সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে সংগঠিত হয়েছিল। প্রাক-ব্রিটিশ আমলে বিদ্যমান ধনী সম্পর্কের ক্ষেত্রে গ্রামই তো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। গ্রাম থেকে কিভাবে শহর গড়ে উঠল এবং পরিবর্তনশীল গ্রাম আস্তে আস্তে শহরের পথে গেল। বৃদ্ধি পেল শিল্পায়ন। সেই শিল্পায়নের হাত ধরে এলো পেট্রল-ডিজেলের চাহিদা, বিদ্যুতের প্রয়োজনীয়তা।
বাংলাদেশ এক দীর্ঘ লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে এগিয়েছে। জ্বালানি তেলের চাহিদা ৭০-৭২ লাখ মেট্রিক টন। ডিজেলের চাহিদা ৪৮-৪৯ লাখ মেট্রিক টন। এই চাহিদার শতকরা ৮০ ভাগ আসে আমদানির মাধ্যমে। সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত—এসব দেশ থেকে আসে অপরিশোধিত জ্বালানি। আর পরিশোধিত তেল আসে সিঙ্গাপুর, ভারত, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, আরব আমিরাত, কুয়েত, থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশ থেকে। আমদানি নির্ভরতা মানেই কিন্তু অর্থনীতির জন্য সেটা নেতিবাচক নয়, সেটা বুঝিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ।
আমাকে আমার এক প্রবীণ সম্পাদক একসময় বলেছিলেন, পৃথিবীর সেরা প্রগতিশীল দেশ বহু ক্ষেত্রেই নিজেরা উৎপাদনের পথে না গিয়ে আমদানির পথে যায়। তার মধ্য দিয়েই একটা নিজস্ব অর্থনীতি গড়ে তোলার প্রয়োজন আছে। আধুনিক অর্থনীতির সঙ্গে এই ধারণা বিশেষভাবে যুক্ত। আমদানি ও রপ্তানির মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করাটা জরুরি। বাংলাদেশ সে ব্যাপারে সব রকমভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
আসলে ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্কের মধুরতার পাশাপাশি দৈনন্দিন পথচলায় অনেক ঘাত-প্রতিঘাত তো আসে, সেখানে সম্পর্কের চড়াই-উতরাই থাকে। কিন্তু ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্কের মধ্যে এমন একটা পারস্পরিক নিবিড় ভালোবাসার ইতিহাস আছে যে সেটা থেকে ভারতের পক্ষেও বাংলাদেশের প্রতি বিরূপ হওয়া কঠিন। আবার বাংলাদেশেরও ভারতের প্রতি কৃতজ্ঞতা অপরিসীম।
শেখ হাসিনা বলেছেন, যখন তাঁর বাবাকে হত্যা করা হলো তখন তিনি বিদেশে ছিলেন ঘটনাচক্রে। তা না হলে তিনিও রেহাই পেতেন না। তারপর কিভাবে শেখ হাসিনা ও তাঁর বোন রেহানাকে ভারত সে সময় সুরক্ষার কবচ দিয়েছিল। এমনকি তাঁর বোনও ছিলেন ভারতীয় নিরাপত্তার সুরক্ষায়। এ সব কথা অনেক দিন পর শেখ হাসিনা স্মরণ করেন, বলেন। একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধাদের যে সাহস, বাংলা ভাষার জন্য একটা দেশের মানুষের যে আত্মত্যাগ, তাকে কখনোই নয়াদিল্লিও ভুলতে পারে না। এটা শুধু কলকাতার বিষয় নয়, এটা সামগ্রিকভাবে ভারতের বিষয়।
শেখ মুজিবের অসম্পূর্ণ আত্মজীবনী পড়ে জানা যায় কিভাবে ভারত তাঁর জীবনে জড়িয়ে ছিল। তাঁর তাজমহল দর্শন থেকে শুরু করে, তাঁর ওপর যখন ১৯৬৭ সালের মাঝামাঝি ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে আটক অবস্থায় তখন তিনি লিখছেন, সেখানে জেল-জুলুম, নিগ্রহ, নিপীড়ন তাঁকে তাড়া করে ফিরেছে। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে তিনি তাঁর জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। তাঁর জীবনীর মধ্যে এসেছে ভারতের স্মৃতি। দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা, দেশভাগ, কলকাতাকেন্দ্রিক প্রাদেশিক মুসলিম ছাত্র নিয়ে মুসলিম লীগের রাজনীতি এবং সেখান থেকে ‘আওয়ামী লীগ’ প্রতিষ্ঠা, নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন—এ সব কিছুর ভেতরে পরতে পরতে জড়িয়ে রয়েছে ভারতের প্রতি ভালোবাসা এবং কৃতজ্ঞতা।
আজ কংগ্রেসের জায়গায় বিজেপি এসেছে ভারতের শাসকদল হিসেবে। কিন্তু বাংলাদেশ নীতিতে কোনো পরিবর্তন আসেনি। নরেন্দ্র মোদিও জানেন, আজ গোটা পৃথিবীর যা হাল, সেখানে বাংলাদেশকে বিশেষভাবে ভারতের প্রয়োজন। এই বহুদিনের বন্ধুত্ব শুধু কূটনৈতিক সম্পর্ক নয়, কোনো আবেগমথিত ডিজেল সরবরাহ পাইপলাইনের ঘটনাটির এক নিছক উদ্বোধনী অনুষ্ঠান নয়, এটা বিপুল তাৎপর্য বহন করছে।